প্রকাশিত: Sat, Apr 20, 2024 1:43 PM
আপডেট: Sun, May 19, 2024 6:46 AM

যাদু, ধর্ম এবং অমঙ্গল

আহসান হাবিব : [১] মঙ্গল শোভাযাত্রাকে আমার যাদু এবং ধর্মের ককটেল প্রদর্শনী মনে হয়। কেন? কিছু প্রাণীকে অমঙ্গলের প্রতীক বানিয়ে মঙ্গল কামনা করা যাদুর প্রকাশ। আবার এই শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে যে ফলাফলের আশা তা যেন কোন অলৌকিকতা মানে অদৃশ্য কোন শক্তির উপর নির্ভরতা। মানুষের সমাজে আগে এসেছে যাদু। যাদু যখন ব্যর্থ তখন এসেছে ধর্ম। যাদু এখন নাই, ধর্ম টিকে আছে। কারণ আদিম ধর্ম আর আজকের ধর্ম এক না, ধর্ম প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে পলিটিকাল হয়ে গেছে। শোষণ এবং ক্ষমতার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে ধর্ম। যাদু প্রায় বিলুপ্ত। 

[২] যাদু এবং ধর্ম দুটোয় অমঙ্গলের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারে না। এটা এক ধরণের মনোবিকলন। আধুনিক এই সমাজে যারা অমঙ্গলের হোতা, তারা খুব শক্তিশালী। এদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই ছাড়া মুক্তি সম্ভব নয়। প্রকৃতির যে সব প্রাণী মানুষের ক্ষতির কারণ- আসলে এটা মানুষের সাপেক্ষে বিবেচনা- তাদেরকে প্রতীক বানিয়ে এই সময়ে যারা মানুষের দুঃখের কারণ, এই শোভাযাত্রা তাদের বিরুদ্ধে একটা সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ। প্রতিবাদ কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্য ছাড়া। ফলে এটা একটা নির্মল উৎসবে পরিণত হয়েছে। অথচ এর উদ্ভব কিন্তু স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এক অসাধারণ অস্ত্র হিসেবে দেখা দিয়েছিল। অস্ত্র হতে পেরেছিল তার একটাই কারণ- এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক শক্তি। মনে পড়ে এরশাদের বিরুদ্ধে একটি স্কেচ কি দারুণ হাতিয়ার হয়ে দেখা দিয়েছিল। সেটা ছিল কামরুল হাসানের আঁকা 'এদেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে'। ছবিটিতে কি ছিল? ছিল এরশাদের মুখাবয়বে হিংস্র প্রাণীর প্রতীক। দাবানলের মত এই ছবি ছড়িয়ে পড়ে এবং রাজনৈতিক শক্তির কাছে এমন এক প্রতীক হয়ে ওঠে যে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তা শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে দেখা দেয়। সেই শোভাযাত্রাটি ক্রমে তার রাজনৈতিক শক্তি হারিয়ে এখন যাদুময় হয়ে উঠেছে। 

[৩] তাহলে ধর্ম কেন এর বিরোধীতা করছে? এটা সা¤প্রদায়িকতা। এর মূল নিহিত আছে সা¤প্রদায়িক রাজনীতির ভেদবুদ্ধিতে। ভারতবর্ষ ধর্মীয় সা¤প্রদায়িকতার পিঠস্থান। এর ইতিহাস এখন সবাই জানে। এখানে রাজনীতি পরিচালিত হয় সা¤প্রদায়িক এটিচুডকে মানদÐ করে। এরা ভাষাকেও সা¤প্রদায়িক বানিয়ে ফেলে। শোভাযাত্রার আগে মঙ্গল শব্দটি এবং কিছু প্রাণীর প্রতীককে সা¤প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে ফেলে সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটায় এই বিরোধীতার একমাত্র কারণ। প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিজ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রতিটি সমাজে কিছু কুসংস্কার, ট্যাবু গড়ে ওঠে। প্রকৃতির যে সব প্রাণী বা বস্তু তাদের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছে, সেসবের বিরুদ্ধে যা কিছু বুজরুকি, তাই কুসংস্কার। কোন কুসংস্কার বা ট্যাবু দিয়ে আর যাই হোক মনস্কামনা পূর্ণ হয় না। তবে এটা সাংস্কৃতিক কর্মকাÐ হিসেবে মানুষ গ্রহণ করে এবং যুগের পর যুগ পালন করে। সবকিছু টিকে থাকে তা নয়, অজস্র এই সব কুসংস্কার হারিয়ে গেছে। এমনকি যুগের রুচীর সংগে অচল সাংস্কৃতিক কর্মকাÐও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। একদা এই মঙ্গল কামনায় নিবেদিত শোভাযাত্রাও তার সৌন্দর্য হারিয়ে হাসির বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। কারণ মানুষ যে শিল্পস্তরে প্রবেশ করেছে এবং ভবিষ্যতে করবে, তা সবই হবে বস্তুর অসীম শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জীবনকে আনন্দময় করে তোলা। যাদু, ধর্ম, সা¤প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, কুসংস্কার, ট্যাবু, মঙ্গল যাত্রা সবই হবে যাদুঘরের বিষয়। লেখক: ঔপন্যাসিক